আশূরায়ে মুহাররম, ইসলামী দৃষ্টিকোণে করণীয় ও বর্জনীয়

প্রকাশিত: মে ১, ২০২৫; সময়: ৮:০৪ পূর্বাহ্ণ |
খবর > ধর্ম

আশুরা’ আরবী শব্দ। যার অর্থ দশম। এখানে দশম দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল হিজরী সালের প্রথম মাস মুহাররমের দশ তারিখ। মহান রাব্বুল আলামীন ১২ মাসের মধ্যে মুহাররম, রজব, যুলক্বা’দাহ ও যুলহিজ্জাহ এই চারটি মাসকে বিশেষ মর্যাদা দান করেছেন।

এই মাসগুলিতে লড়াই-ঝগড়া, খুন-খারাবী ইত্যাদির অন্যায়-অপকর্ম হ’তে দূরে থেকে এর মর্যাদার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা প্রত্যেক মুমিন বান্দা ও

বান্দীর ধর্মীয় কর্তব্য। আল্লাহ বলেন, فَلَا تَظْلِمُوا فِيْهِنَّ

اَنْفُسَكُمْ ‘এই মাসগুলিতে তোমরা পরষ্পরের উপর

অত্যাচার কর না’ (তওবা ৩৬)। ইসলামের ইতিহাসে মুহাররমের দশম দিন অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। হযরত আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘রামাযানের পরে সর্বোত্তম ছিয়াম হ’ল মুহাররাম মাসের ছিয়াম এবং ফরয ছালাতের পরে সর্বোত্তম ছালাত হ’ল রাতের নফল ছালাত।

১০ই মুহাররম ইমাম হুসায়েন (রাঃ) কারবালা প্রান্তরে

শাহাদত বরণ করেন। তাঁর শাহাদতের হৃদয় বিদারক ঘটনাকে স্মরণ করে এক শ্রেণীর অজ্ঞ লোক প্রতিবছর উক্ত দিনটি পালন করে থাকে।

কিন্তু আমাদের সকলের জেনে রাখা উচিৎ যে, ফেরাউনের কবল থেকে মূসা (আঃ)-এর মুক্তি লাভের কারণে ১০ই মুহাররমের প্রতি ইসলাম গুরুত্ব আরোপ করেছে।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মদীনায় হিজরত করে ইহুদীদেরকে আশূরার ছিয়াম পালন করতে দেখে কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা বলল, এটি একটি মহান দিন।

এইদিনে হযরত মূসা ও তাঁর জাতীকে আল্লাহপাক নাজাত দিয়েছিলেন ও ফেরাউন ও তার দলকে নদীতে ডুবিয়ে মেরেছিলেন। আল্লাহর শুকরিয়া হিসাবে মূসা (আঃ) এইদিন ছিয়াম পালন করেন।

অতএব আমরাও এই দিনে ছিয়াম পালন করি। তখন আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বললেন, ‘মুসার প্রতি তোমাদের চেয়ে আমাদের বেশী হক রয়েছে। অতঃপর তিনি ছিয়াম পালন করলেন ও সকল মুসলমানকে ছিয়াম পালন করার নির্দেশ দিলেন।

করণীয় : 

নবী করীম (ছাঃ) ১০ই মুহাররমে ছিয়াম পালন করেছেন ও তাঁর উম্মতগণকে উহা পালন করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘তোমরা আশূরার ছিয়াম পালন কর ও ইহুদীদের খেলাফ কর। তোমরা আশূরার সাথে তার পূর্বে একদিন বা পরে একদিন ছিয়াম পালন কর। অর্থাৎ ৯, ১০ অথবা ১০, ১১ই মুহাররম ছিয়াম পালন কর (যা পূর্ব থেকেই তাঁর রাখার অভ্যাস ছিল)।

হযরত আবু ক্বাতাদাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘আশূরা বা ১০ই মুহাররমের ছিয়াম আল্লাহর নিকটে বান্দার বিগত এক বছরের ছগীরা গোনাহ-এর কাফ্ফারা হিসাবে গণ্য হয়ে থাকে’।

উপরোল্লিখিত হাদীছ সমূহ দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে,

(ক) আশূরার ছিয়াম ফিরাউনের কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার কারণে মূসা (আঃ) আল্লাহর শুকরিয়া হিসাবে পালন করেছিলেন।

(খ) ২য় হিজরীতে রামাযানের ছিয়াম ফরয হওয়ার আগ পর্যন্ত এই ছিয়াম সকল মুসলমানের জন্য নিয়মিত পালিত হ’ত।

(গ) রামাযানের ছিয়াম ফরয হওয়ার পরে এই ছিয়াম ঐচ্ছিক ছিয়ামে পরিণত হয়। তবে রাসূল (ছাঃ) নিয়মিত এই ছিয়াম ঐচ্ছিক হিসাবেই পালন করতেন। এমনকি মৃত্যুর বছরেও তিনি পালন করতে চেয়েছিলেন। এই ছিয়ামের ফযীলত হিসাবে বিগত এক বছরের গোনাহ মাফের কথা বলা হয়েছে। এত বেশী নেকী আরাফার দিনের নফল ছিয়াম ব্যতীত অন্য কোন নফল ছিয়ামে নেই।

(ঘ) মুহাররমের ছিয়াম মূসা, ঈসা ও উম্মতে মুহাম্মাদীতেও ছিল এবং আজও চালু আছে। আইয়ামে জাহেলিয়াতেও আশূরার ছিয়াম পালিত হ’ত।

(ঙ) আশূরার ছিয়ামের সাথে হযরত হুসায়েন বিন আলী (রাঃ)-এর জন্ম বা মৃত্যুর কোন সম্পর্ক নেই। হুসায়েন (রাঃ)-এর জন্ম মদীনায় ৪র্থ হিজরীতে এবং মৃত্যু ইরাকের কুফা নগরীর নিকটবর্তী কারবালা নামক জায়গায় ৬১ হিজরীতে রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর প্রায় ৫০ বছর পরে হয়।

মোটকথা মুহাররমে ২টি নফল ছিয়াম পালন ব্যতীত আর কিছুই করার নেই। সাবধান। হুসায়েনের শাহাদতের নিয়তে ছিয়াম পালন করলে নেকী পাওয়া যাবে না। কারণ, এই ছিয়াম হুসায়েনের জন্মের বহু পূর্ব হ’তে পালিত হয়ে আসছে।

বর্জনীয় : 

এক শ্রেণীর ভণ্ড লোকেরা ১০ই মুহাররম ইমাম হুসায়েন (রাঃ)-এর শাহাদতের স্মরণে শোক মিছিল বের করে, মর্সিয়া ও শোকগাঁথা গায়, ‘হায় হোসেন’ ‘হায় হোসেন’ করে মাতম করে, ইমাম হুসায়নের (রাঃ) নকল কবর তৈরী করে, শরীরের অংশ বিশেষ কেটে নিজেকে রক্তাক্ত করে। ঐ ভূয়া কবরে হুসায়েনের রূহ হাযির হয় ধারণা করে তাকে সালাম করা হয়। তার সামনে মাথা ঝুঁকানো হয়।

সেখানে সিজদা করা হয়। মনোবাঞ্ছা পূরণ করার জন্য প্রার্থনা করা হয়। মিথ্যা শোক প্রদর্শন করে বুক চাপড়িয়ে কাপড় ছিঁড়ে ফেলা হয়।

রক্তের নামে লাল রং ছিটানো হয়। রাস্তাঘাট রং-বেরং সাজে সাজানো হয়।

লাঠি-তীর-বল্লম নিয়ে যুদ্ধের মহড়া দেওয়া হয়। হুসায়েনের নামে কেক, পিঠা ও পাউরুটি বানিয়ে বরকতময় পিঠা বলে বেশী মূল্যে বিক্রি করা হয়।

সুসজ্জিত অশ্বারোহীদল মিছিল করে কারবালা যুদ্ধের মহড়া দেয়। হুসায়েনের নামে পুকুরে মোরগ ছুড়ে যুবক যুবতীরা পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঐ ‘বরকতের মোরগ’ ধরার প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে। কালো পোশাক পরিধান বা কালো ব্যাচ ধারণ করা হয়। এমনকি অনেকে এই মাসে বিবাহ শাদী করা অন্যায় মনে করে থাকেন।

ঐদিন অনেকে পানি পান করা এমনকি শিশুর দুধ পান করানোকেও অন্যায় ভাবেন। উগ্রপন্থী শী’আরা কোন কোন ‘ইমাম বাড়া’তে হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর নামে বেঁধে রাখা একটি বকরীকে লাঠি পেটা করে ও অস্ত্রাঘাতে রক্তাক্ত করে বদলা নেয় ও উল্লাসে ফেটে পড়ে।

তাদের ধারণা মতে আয়েশা (রাঃ)-এর পরামর্শক্রমেই আবুবকর (রাঃ) রাসূল (ছাঃ)-এর অসুখের সময় জামা’আতে ইমামতি করেছিলেন ও পরে খলীফা নির্বাচিত হয়েছিলেন।

সে কারণে আলী (রাঃ) খলীফা হ’তে পারেননি (নাউযুবিল্লাহ)। এছাড়া হযরত উমর, হযরত উছমান, হযরত মু’আবিয়া, হযরত মুগীরা বিন শো’বা (রাঃ) প্রমুখ জলীলুল হৃদর ছাহাবীগণকে বিভিন্নভাবে গালীগালাজ করে।

এ ছাড়াও রেডিও-টিভি, পত্র-পত্রিকা, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় সমূহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একথা বুঝানোর চেষ্টা করে যে, ১০ই মুহাররমের মূল বিষয় হ’ল শাহাদতে হুসায়েন (রাঃ) বা কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা।

চেষ্টা করা হয় এটাকে হক ও বাতিলের লড়াই হিসাবে প্রমাণ করতে। চেষ্টা করা হয় হুসায়েনকে মাছুম (নিষ্পাপ) ও ইয়াযীদকে ‘মাল’উন’ (অভিশপ্ত) প্রমাণ করতে। অথচ প্রকৃত সত্য এসব থেকে অনেক দূরে।

আশূরা উপলক্ষ্যে ঐসব বিদ’আতী ও শিরকী অনুষ্ঠানের কোন দলীল পাওয়া যায় না। এসব বানানো ও ভূয়া। আল্লাহ ব্যতীত কাউকে সিজদা করা হারাম। তাছাড়া ভূয়া কবর যিয়ারত করা মূর্তিপূজার শামিল। যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ভূয়া কবর যিয়ারত করল, সে যেন মূর্তিকে পূজা করল’।

অনুরূপভাবে শোক গাঁথা বা মর্সিয়া অনুষ্ঠান ইসলামী শরীয়তের পরিপন্থী। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত নবী করীম (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি গায়ে আঘাত করে, কাপড় ছিঁড়ে এবং জাহেলী যুগের ন্যায় মাতম করে, সে আমাদের দলভুক্ত নয়’।

কারবালার ঘটনাকে স্মরণ করে অনেকে ইয়াযীদ, মু’আবিয়া আমর ইবনুল আছ (রাঃ) প্রমুখ ছাহাবীকে গালি-গালাজ করে। এটি গোনাহের কাজ।

ছাহাবীগণ সম্পর্কে প্রত্যেক মুসলমানদের এই আক্বীদা পোষণ করা উচিৎ যে, তাদের কোন প্রকার সমালোচনা থেকে অন্তর ও জিহ্বাকে সংরক্ষণ করতে হবে, তাদের গালী-গালাজ করা যাবে না, বরং তাদের জন্য দো’আ করতে হবে, তাদের মধ্যে যেসব মতবিরোধ রয়েছে সে সম্পর্কে মতামত প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে তাদের যে মর্যাদায় ভূষিত করা হয়েছে সেটি মেনে নিতে হবে। নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমরা আমার ছাহাবীদের গালী-গালাজ করোনা।

আল্লাহর কসম তোমাদের কেউ ওহোদ পাহাড় সমতুল্য স্বর্ণ (আল্লাহর পথে) ব্যয় করলেও তাদের একজনের এক মুষ্ঠির অর্ধেক পরিমাণ পৌঁছতে পারবেনা’।

শী’আদের ঐ সব শোকসভা বা শোকমিছিলে বাড়াবাড়ি করে সৃষ্টি ও সৃষ্টিকর্তার পার্থক্য মিটিয়ে দিয়ে হুসায়েনের কবরে রূহের আগমন কল্পনা করা, সেখানে সিজদা করা, মাথা ঝুঁকানো, প্রার্থনা করা ইত্যাদি পরিষ্কারভাবে শিরক।

অতএব আমরা যেন আশূরার ছিয়াম পালন করে আল্লাহ নৈকট্য হাছিল করার চেষ্টা করি, ইমাম হুসায়েনের (রাঃ) শাহাদতের ঘটনা থেকে শিক্ষা লাভ করি এবং আশূরাকে ঘিরে যে সকল ভ্রান্ত ধারণা ও ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপ সমাজে চালু আছে তা থেকে নিজেকে ও অপরকে বিরত রাখতে তৎপর হই।

সাথে সাথে নিজেদের ব্যক্তি জীবন ও বৈষয়িক জীবন এবং সর্বোপরি আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে নিখুঁত ইসলামী ছাঁচে ঢেলে সাজাবার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করি। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন-আমীন!!

[TheChamp-FB-Comments style="background-color:#f0f0f0"]
উপরে