কালের বিবর্তনে হারানোর পথে বরেন্দ্র অঞ্চলের মাটির বাড়ি

প্রকাশিত: এপ্রিল ২৯, ২০২৫; সময়: ১২:২০ অপরাহ্ণ |

নিজস্ব প্রতিবেদন : বরেন্দ্র অঞ্চল, বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের এক প্রাচীন জনপদ, এক সময় পরিচিত ছিল তার মাটির তৈরি ঘরবাড়ির জন্য। এই ঘরগুলো শুধু বাসস্থান ছিল না, ছিল একটি সময়ের জীবনের প্রতিচ্ছবি। শত বছর ধরে মানুষের হাতে তৈরি এই মাটির ঘরগুলো এখন ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে যাওয়ার পথে। কালের বিবর্তনে, প্রযুক্তির উন্নয়ন আর মানুষের জীবনধারার পরিবর্তনে বিলুপ্তির হুমকিতে পড়েছে এই স্থাপত্য ঐতিহ্য।

রাজশাহী, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ বরেন্দ্র অঞ্চলের গ্রামাঞ্চলে আগে প্রতিটি পরিবারই মাটির ঘরে বসবাস করত। এই ঘরগুলো তৈরি হতো স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা শক্ত লালচে মাটি দিয়ে। খড়, বাঁশ, মাটির ছাদ, ছোট ছোট জানালা—সবকিছু মিলিয়ে ঘরগুলো ছিল সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক ও পরিবেশবান্ধব। গ্রীষ্মে ঘরের ভেতর ঠাণ্ডা থাকত, শীতে উষ্ণ। বিদ্যুৎ কিংবা এসির প্রয়োজন হতো না। গৃহস্থালি কাজের সুবিধাও ছিল এসব ঘরে। মাটির উঠোনে সকাল-বিকেল চলত রান্নাবান্না, আড্ডা, আর পারিবারিক নানা আয়োজন।

এই ঘরগুলো শুধু দৈনন্দিন জীবনের অংশই ছিল না, গ্রামীণ সংস্কৃতির মূল শিকড় হিসেবেও বিবেচিত হতো। ঘরের দেয়ালে তুলসী গাছের পাশে ঝোলানো থাকত মাটির হাড়ি, উঠোনে পাতা মোড়া, কাঁথা সেলাইয়ের দৃশ্য—সবই ছিল এক নিঃশব্দ সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ ঝুঁকে পড়েছে ইট, সিমেন্ট আর টিনের ঘরের দিকে। মাটির ঘরকে এখন কেউ কেউ “পিছিয়ে পড়ার প্রতীক” বলেই মনে করে।

রাজশাহীর বাঘা উপজেলার বাসিন্দা মোজাম্মেল হোসেন জানালেন, তার দাদার বানানো মাটির ঘরে তিনি বড় হয়েছেন। এখন সেই ঘর প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে, পাশেই তুলেছেন পাকা দোতলা ঘর। তিনি বলেন, “মাটির ঘরের আবেগটা থাকলেও টিকিয়ে রাখা যায় না। বৃষ্টিতে দেয়াল গলে যায়, স্যাঁতসেঁতে ভাব এসে পড়ে। এখনকার ছেলেমেয়েরা চায় আধুনিক বাড়ি।”

আধুনিকতার প্রভাবে মানুষ নতুন ঘর নির্মাণে আগ্রহী হলেও মাটির ঘরের প্রতি যথাযথ গুরুত্ব বা সংরক্ষণের তাগিদ দেখা যায় না। অথচ, এই ঘরগুলো নির্মাণে পরিবেশে কোনও দূষণ হয় না, ব্যয়ও কম, এবং সহজলভ্য উপাদানে তৈরি করা সম্ভব। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় রক্ষণাবেক্ষণে। নিয়মিত সংস্কার না করলে দেয়াল ক্ষয়ে পড়ে, বর্ষায় ছাদ চুইয়ে পড়ে পানি। একসময় যা ছিল পরিচিত দৃশ্য, আজ তা অনেকের কাছেই অচেনা হয়ে উঠছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাটির ঘর শুধু একটি নির্মাণ নয়, এটি এক প্রজন্মের সংস্কৃতি ও পরিচয়ের প্রতীক। এই ঘর হারিয়ে যাওয়া মানে একটি ঐতিহ্যের বিলুপ্তি। তারা মনে করেন, সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে এই ঘরগুলোর নথিভুক্তকরণ, সংরক্ষণ এবং নতুন প্রযুক্তির সহায়তায় টেকসইভাবে পুনর্নির্মাণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কিছু কিছু দেশে মাটির ঘরকে ঘিরে পর্যটন শিল্পও গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশেও এই সম্ভাবনা রয়েছে, যদি উদ্যোগ নেওয়া হয় সময়মতো।

এই মুহূর্তে বরেন্দ্র অঞ্চলের কোথাও কোথাও এখনও কিছু মাটির ঘর টিকে আছে, তবে তা হাতে গোনা। একসময় যে দৃশ্য ছিল প্রতিটি পাড়ায়, এখন তা দেখা যায় শুধুই পুরোনো ছবি আর স্মৃতিচারণায়। মাটির দেয়ালের গায়ে লেপে রাখা জীবনের গল্পগুলো আজ ধূলিধূসরিত। এই ধারা অব্যাহত থাকলে অচিরেই বরেন্দ্র অঞ্চলের মাটির ঘর হয়ে উঠবে নিছক ইতিহাসের অংশ — বইয়ের পাতায় রয়ে যাবে, বাস্তবে আর নয়।

 

[TheChamp-FB-Comments style="background-color:#f0f0f0"]
উপরে